রবিবার, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:৫০ পূর্বাহ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদক: চলছে ইলিশ ধরার ভরা মৌসুম। কিন্তু বৈরী আবহাওয়ার কারণে বরিশালের নদ-নদীতে মিলছে না কাঙ্খিত ইলিশ। খালি হাতে ফিরছেন জেলেরা। ফলে বরিশালের বৃহৎ মৎস্য আড়ত পোর্টরোডে নেই হাঁক-ডাক। শ্রমিকরা জানান সংসার চালানো দায় পড়ছে তাদের। তারা বলেন, যতটুকু ইলিশ উঠছে, তার দামও অস্বাভাবিক। এদিকে ভারতে ইলিশ রপ্তানী বন্ধের খবরে ক্রেতারা ইলিশ কিনতে এসেও ফিরছেন ইলিশ ছাড়াই। গত বছরের তুলনায় এ সময়টাতে ইলিশের দাম তুলনামূলক বেড়েছে। নগরীর পোর্টরোড ইলিশের আড়ত ঘুরে এমন চিত্রই দেখা গেছে।
আড়তদারদের দাবি, যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল হওয়ায় দখিনের মহিপুর বন্দর থেকে দেশের বিভিন্ন জেলায় মাছ পাঠিয়ে দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। ফলে লোকাল নদী ছাড়া অন্যান্য নদী কিংবা সাগরের মাছ বরিশালে আসছে না। একই কথা বলছেন মৎস্য কর্মকর্তারা। তবে বর্তমানে যে আবহাওয়া বিরাজ করছে তাতে শীঘ্রই প্রচুর ইলিশ ধরা পড়বে বলে আশাবাদী তারা।
বরিশালের বৃহৎ মৎস আড়ত পোর্টরোডে গিয়ে দেখা গেছে, ৫শ’ থেকে ৬৫০ গ্রাম ওজনের ইলিশ মন প্রতি বিক্রি হচ্ছে ৪৫ হাজার টাকায়। ৭শ থেকে ৯৫০ গ্রাম ওজনের মন ৫৮ হাজার টাকা, ১ কেজি সাইজের ইলিশের মন ৬৫ হাজার টাকা, দেড় কেজি ওজনের ইলিশ ৬৫ হাজার টাকা এবং ২ কেজি ওজনের ইলিশের দর ৮৮ হাজার টাকা। আর জাটকা বিক্রি হচ্ছে ২৮ হাজার টাকা মন।
তবে গত মৌসুমে এই ৭শ থেকে ৯শ গ্রাম ওজনের ইলিশের বাজার দর ছিল মণ প্রতি ৫৫ হাজার টাকা, এক কেজি ওজনের মাছ ৬০ হাজার টাকা, দেড় কেজি ওজনের ইলিশ ৬৩ হাজার টাকা, ৫শ থেকে ৬শ গ্রাম ওজনের ইলিশ ৫০ হাজার টাকা এবং জাটকা ইলিশ বিক্রি হয়েছে ২৭ হাজার টাকা দরে।
ইলিশ ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাজারে মাছের যোগান বেশি হলে দাম কমতো। চাহিদার তুলনায় মাছ কম আসায় দাম একটু বেশি। তবে যে পরিমান মাছ আসছে তাতে শ্রমিকদের মজুরি দিয়ে চালানো সম্ভব নয়। অপরদিকে জেলেরা বলছেন, কাঙ্খিত ইলিশ পাওয়া না গেলে তাদের ঋণের বোঝা বাড়বে।
মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, গত ১ জুলাই থেকে ইলিশ ধরার মৌসুম শুরু হয়েছে। বর্ষার চিরচেনা এই পরিবেশে নদ-নদীতে বেশি বেশি ইলিশ ধরা পড়ার উপযোগী সময়। সে অনুযায়ী এখন আড়তগুলো ইলিশে ভরপুর থাকার কথা। কিন্তু চলতি বছরে আবহাওয়ার ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। একদিকে যেমন অতিরিক্ত গরম অন্যদিকে ভাড়ি বর্ষা। এ কারণে হয়তো কাঙ্খিত ইলিশ আসছে না আড়তগুলোতে। বরিশাল পোর্টরোডের শ্রমিক ইয়াছিন মিয়া বলেন, বিগত দিনে এমন সময় ইলিশে আড়ত সয়লাব থাকতো। কাজের চাপে আমরা ভাত খাওয়ার সময় পর্যন্ত পেতাম না। অথচ এখন মাছ না থাকায় অলস সময় পার করতে হচ্ছে। যে মাছ আসছে তা দিয়ে ভাত খাওয়ার খরচও ওঠে না।
পোর্টরোডে আসা জেলেরা বলেন, ইলিশের প্রধান বিচরণক্ষেত্র বরিশাল ও ভোলা জেলার পাশ দিয়ে প্রবাহিত মেঘনা নদী। এর শাখা তেঁতুলিয়া, আড়িয়াল খাঁ ও কালাবদর নদীতেও পর্যাপ্ত ইলিশ পাওয়া যায়। গত দু-তিন মাসে তারা নামমাত্র ইলিশ পেয়েছেন। তারা জানান, প্রতি বছরই মেঘনায় ইলিশ কমছে। মৌসুমের শেষ পর্যায়ে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে আগের চেয়ে কিছুটা বেশি পাওয়া যায়। তবে এ বছর তুলনামূলক কম মাছ ধরা পড়ছে। আজ থেকে পাঁচ বছর আগে এই সময়ে যে পরিমাণ ইলিশ পাওয়া যেত, এখন অনেক কম পাওয়া যায় বলেন তারা।
পোর্ট রোডের মাছ ব্যবসায়ী আনোয়ার বলেন, ইলিশের ভরা মৌসুমেও ইলিশ নেই। মৌসুমের এক মাস পার হলেও আশানুরূপ মাছ পাচ্ছি না। তাছাড়া সাগরের ইলিশ বরিশালের বাজারে আসছে না। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হওয়ায় দেশের বিভিন্ন জেলায় মাছ চলে যায়। এতে জেলেরাও লাভবান হয়। তিনি বলেন, মহিপুর বন্দরে তারা মাছ নিয়ে গেলে খরচ কম পড়ে। এজন্য দখিনের জেলাগুলো থেকে বরিশালে মাছ আসছে না।
পোর্টরোডের সায়মা আড়তের প্রোপ্রাইটর মোশারফ হোসেন বলেন, এমন ইলিশ সংকট বরিশালে কখনোই হয়নি। ভারতে রপ্তানি বন্ধ হয়েছে তাতে আমাদের বাজারে কোনো প্রভাবই নেই। কারণ ইলিশ আমাদের নদীতে নেই। আমরা এখন পুরোপুরি লোকসানের মুখে।
এদিকে আড়তে ইলিশ না থাকায় বরফ উৎপাদনও কমে গেছে বলে জানান বরফকল মালিকরা। চিশতি এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, বিগত মৌসুমে এমন দিনে বরফ উৎপাদন করে শেষ করতে পারতাম না। এবার মাছ না থাকায় বরফ উৎপাদন বন্ধ। যে পরিমাণ মাছ আসছে তাতে বরফকল চালিয়ে খরচ উঠে না।
বরিশাল জেলা মৎস্য কর্মকর্তা (ইলিশ) বিমল চন্দ্র দাস বলেন, ইলিশ সংকটের এ চিত্র এখন দক্ষিণাঞ্চলের সব নদ-নদীতে। যার বিরূপ প্রভাব পড়েছে বাজারে। সরবরাহ না থাকায় ইলিশের দাম কিছুটা বেড়েছে। তিনি বলেন, সাগরে যে ইলিশ ধরা পড়ছে তা বরিশালের বাজারে আসছে না। আবার স্থানীয় নদীতেও কাঙ্খিত ইলিশ মিলছে না। তবে শীঘ্রই বরিশালে নদ-নদীতে ইলিশ ধরা পড়বে বলে আশাবাদী তিনি।
বরিশাল জেলা মৎস্য কর্মকর্তা রিপন কান্তি ঘোষ বলেন, মাছের উৎপাদন ঠিকই আছে। সমস্যা হচ্ছে সড়ক যোগাযোগ উন্নত হওয়ায় এখন আর আড়তে আসতে হয় না জেলেদের। যেমন মেহেন্দীগঞ্জ, হিজলা, ভোলার জেলেরা মাছ ধরে হয় ঢাকা না হয় চাঁদপুরে নিয়ে যায়। আবার বরগুনা, পটুয়াখালী এলাকার জেলেরা সড়ক পথে সরাসরি ঢাকায় পাঠাচ্ছে। এজন্য স্থানীয় বাজারগুলোতে চাহিদার বেশি ইলিশ সরবারহ হচ্ছে না।
Leave a Reply